ঢাকার অদূরে সাভারে চামড়াশিল্প নগরী গড়ে তুলতে ২০০৩ সালে প্রকল্প নিয়েছিল সরকার। পরিবেশবান্ধব এই প্রকল্পের কাজ তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চারবার সংশোধন আনা সেই প্রকল্পটি ১৮ বছরেও শেষ করা যায়নি।
আর পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় বর্তমানে চামড়া শিল্প সংশ্লিষ্টদের বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সার্টিফিকেট পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে বিদেশি বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশি চামড়ার তৈরি পণ্য কেনে না। এতে বিপাকে পড়েছে ট্যানারি মালিকরা।
তারা বলছেন, এমনিতেই করোনা সংকট তার উপর চামড়া শিল্প নগরির কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় তারা চিন্তিত। তবে চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক জিতেন্দ্রনাথ পাল বলেন, চলতি বছরের জুনের মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে যেত কিন্তু করেনার কারণে কাজ বন্ধ থাকায় সেটা সম্ভব হয়নি।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ‘চামড়া শিল্পনগরী’ প্রকল্পর তৃতীয় সংশোধনি সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ছিল চামড়া শিল্পের গুরুত্ব বিবেচনা দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে আরও একটি করে চামড়া শিল্পনগরী স্থাপনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার।
কিন্তু সে উদ্যোগ তো দূরের কথা এখনও সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর কাজই শেষ হয়নি। গতবছর চতুর্থবারের মতো এ প্রকল্পের সময় বাড়ানোর সময় প্রধানমন্ত্রী সতর্ক করে দিয়েছিলেন আর যেন এ প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়ে। কিন্তু করোনা সংকটে জন্য এ প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে বলে ঢাকাটাইমসকে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক জিতেন্দ্রনাথ পাল।
২০১৭ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে রাজধানী হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর শুরু হয়। এরপর হাজারীবাগসহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে ১৫৫টি ট্যানারি স্থানান্তর করা হয়েছে।
ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘২০১৭ সালে হাজারীরাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর করা হয়। তখন থেকেই আমরা সংকটে পড়েছি। আমরা বারবার বলেছিলাম চামড়াশিল্প নগরীর কাজ শেষ হয়নি। শেষ হলে আমরা যাবো। কিন্তু এরপরও আমাদের সেখানে পাঠানো হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রকল্পের কাজ এখনও শেষ হয়নি। সিইটিপির কাজ ডাম্পিংয়ের কাজ এখনও বাকি। সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টও নেই। এগুলো নিয়ে আমরা চিন্তিত। তারপরও আশা করি সরকার অতিদ্রুত সমাধান করবে।’
বর্তমানে চামড়া শিল্পনগরীতে ১৫৫টি ট্যানারি আছে জানিয়ে সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এসব ট্যানারির মধ্যে উৎপাদনে আছে ১৩৫টি।
আন্তর্জাতিক মার্কেটে চামড়া বিক্রি করতে হলে এলডব্লিউজির সার্টিফিকেট লাগে। কিন্তু এলডব্লিউজির কর্তৃপক্ষ সাভারে সিইটিপি বা ডাম্পিং ইয়ার্ড প্রস্তুত না হওয়ার কারণে এ সার্টিফিকেট দেয়নি। এখনো এলডব্লিউয়ের ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মানদণ্ড অনুযায়ী হয়নি সাভারের ট্যানারি পল্লীর পরিবেশ।
চামড়াশিল্প নগরী এখনও এলডব্লিউজি সনদ না পাওয়ার বিষয়ে বিটিএ সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এখনও কাজ হয়নি। এলডব্লিউজি সনদ পাওয়ার মতো এখনও কিছু করতে পারেনি। যারা অডিট করতে আসবে তারা দেখবে সিইটিপি ঠিক আছে কি-না। তারপর সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, এগুলোর কাজই তো শেষ হয়নি। এটা নিয়ে আমরা চিন্তিত।’
প্রসঙ্গত, চামড়াশিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য অবকাঠামো সুবিধা ও পরিবেশবান্ধব শিল্পনগরী গড়ে তুলতে সাভারের হেমায়েতপুরে ১৯৯ একর জমির ওপর চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল ২০০৩ সালে। মোট ১৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়।
কথা ছিল ২০০৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৫ সালের ডিসেম্বরের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের অনুকূলে সাহায্য সংস্থান না হওয়ায় অর্থায়নের ধরন পরিবর্তন করা হয়। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে একনেক মোট ৫৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০০৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রথম সংশোধন করা হয়।
দ্বিতীয়বার সংশোধন করে এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০০৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন দেয় একনেক। তারপরও কাজ শেষ না হওয়ায় তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১৯ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু এ সময়ও শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ তাই গত বছর ডিসেম্বরে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়।
এসটিপির অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্নকরণ; মেইন গেট নির্মাণ; প্রশাসনিক কার্যালয়ের লিফট স্থাপন, স্ট্রিট লাইট স্থাপন কার্যক্রম সমাপ্তকরণ; কমন ইউটিলিটির জন্য নির্ধারিত স্থান সংরক্ষণে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ; তিনটি ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ এবং এসপিজিএস নির্মাণ কাজ আলাদাভাবে করার জন্য কার্যক্রমগুলো প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার জন্য চতুর্থবারের মতো প্রকল্পটির মেয়াদ একবছর বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটির চতুর্থ সংশোধনীতে মেয়াদ বাড়লেও প্রকল্পটির ব্যয় ৬৩ কোটি টাকা কমিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। তাই প্রকল্পটির ব্যয় এক হাজার ৭৮ কোটি থেকে এক হাজার ১৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকায় নেমে আসে।
বুড়িগঙ্গা নদী ও এর আশপাশের এলাকার পরিবেশ দূষণ রোধে ২০১৭ সালে হাজারীরাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হয়। সে সময় ট্যানারি মালিকরা বার বার বলেছিল ট্যানারি শিল্প সম্পূর্ণ হয়নি। কিন্তু তাদের কথা শোনা হয়নি। এতদিনেও কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া এবং চামড়াশিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) সঙ্গে সমন্বিত সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (এসটিপি) নির্মাণ না হওয়া, কঠিন বর্জ্যের ডাম্পিং ইয়ার্ড তৈরির কাজ শেষ না হওয়ায় এখন ধলেশ্বরী নদী দূষিত হচ্ছে।
এই অবস্থায় শিল্পনগরীতে এবার ঈদুল আজহার কোরবানির পশুর চামড়া আসবে। ঈদে এক কোটির বেশি পশু কোরবানি হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। এই পশুর চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করা হবে শিল্পনগরীতে। এর ফলে দূষণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক জিতেন্দ্রনাথ পাল বলেন, ‘এখন প্রায় কাজ শেষ হয়ে গেছে। সিইটিপির কাজ পরিপূর্ণরুপে শেষ হয়েছে শুধু অনলাইন মনিটরিং সেটা বাদ আছে। আর কোনও সমস্যা নেই। পরিক্ষামূলক চলতেছে গত দুই মাস ধরে। সিইটিপির কাজ ওকে এখন রং-চং কিছু বাকি রয়েছে, ফাংশনে সমস্যা নেই। সলিট ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট যেটা সেটা আমাদের ইমার্জেন্সির জন্য তিনটি ডাম্পিং ইয়ার্ড আলাদাভাবে করা হচ্ছে। সেটার কাজ শেষের দিকে। আমার মনে হয় এটা নিয়ে সমস্যা হবে না।’
জিতেন্দ্রনাথ পাল বলেন, ‘করোনার কারণে ২০২১ সালে জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এত সময় হয়তো আমাদের লাগবে না। তার আগেই সব কাজ শেষ করতে পারবো। মূল কাজ ডিসেম্বরেই শেষ হয়ে যাবে আমরা আশাবাদী।