রাজধানী ঢাকার ১৬২ বছরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা একসময়ের ছোট্ট পাঠশালাটি আজ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়। পাঠশালা থেকে কলেজ, কলেজ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করে ১১ একরের এই ছোট ক্যাম্পাস।
১৮৫৮ সালে ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল নামে এর প্রতিষ্ঠা। ১৮৭২ সালে জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী তার বাবার নামে জগন্নাথ স্কুল নামকরণ করেন। ১৯০৮ সালে এটাকে কলেজে পরিণত করা হয়। পরে নানা সংগ্রাম ও চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাস করার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠান একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। সেই থেকে সীমিত ক্যাম্পাস, আবাসন সমস্যা, পরিবহন সমস্যা, অপ্রতুল গবেষণাসহ নানা সংকট নিয়েও সফলতার হাতছানি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৬তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। আজ (২০ অক্টোবর) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস।
পাঠশালা থেকে পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়া নবীন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি কালের বিবর্তনে সময়ের দাবি মিটিয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে অতিক্রম করছে সফলতার ১৫টি বছর। ১১ একরের ছোট্ট এই ক্যাম্পাসে রয়েছে ২০ হাজার শিক্ষার্থীর স্বপ্নবাস। উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও
সুস্থ ছাত্র রাজনীতির শিক্ষাঙ্গন এই বিশ্ববিদ্যালয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ দেশে, তবে অন্যকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই এত অল্প সময়ে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠ হিসেবে স্থান করে নিতে পারেনি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে নবীন একটি বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর রয়েছে প্রায় দেড়শ বছরের গৌরব ও ঐতিহ্য। এত বছরের ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও জবি বাংলাদেশের একমাত্র অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে খ্যাত। এছাড়াও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে নানা সংকট, অপর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত সমস্যা, ভূমি সংকট, শিক্ষার্থীদের গবেষণা খাতে স্বল্প বাজেট। এত অপর্যাপ্ততা আর এই সীমাহীন সংকটের মধ্য থেকেও এই বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাচ্ছে। ছুটে চলছে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে।
এছাড়াও দেশের প্রতিটি সেক্টরসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, প্রাইভেট সেক্টর, বিদেশে উচ্চশিক্ষাসহ সর্বক্ষেত্রে জায়গা করে নিচ্ছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এসআই নিয়োগ থেকে শুরু করে বিসিএসসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি চাকরিগুলোতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুরুর দিকে স্থান দখল করে আছেন। প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছেন দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে।
এছাড়াও প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মাস্টার্স, পিএইচডি গবেষণা করতে যান। আর জগন্নাথকে করে তোলেন বিশ্বের বুকে সমাদৃত। এই সফলতার পেছনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল কৃতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর নাম গর্ব করে বলতেই হয় তারা হলেন- ইতিহাসবিদ ড. মাহমুদুল হাসান, সাংবাদিক রাহাত খান, আ ন ম বজলুর রহমান, সংগীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী, হায়াৎ মাহমুদ, বিক্রমপুরের ইতিহাসখ্যাত লেখক শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, বাংলাদশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ, কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান, প্রখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্রবিশারদ যোগেশচন্দ্র ঘোষ, শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়া সাঁতারু ব্রজেন দাস।
এছাড়াও চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, জাহিদ হাসান, মীর সাব্বির, ফারুক, প্রবীর মিত্র, জাদুকর জুয়েল আইচ প্রমুখ। ২০১৯ সালের এসএ গেমসে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক লাভ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মারজান আক্তার প্রিয়া।
বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে অত্যাধুনিক করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যাল
প্রশাসন। ছাত্রীদের আবাসন সংকট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে ১৬ তলাবিশিষ্ট বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। যা আজ বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে উদ্বোধন হবে।
এছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের জন্য নতুন করে তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক ল্যাব। পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে রয়েছে ইন্টারনেটের ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য তৈরি হচ্ছে আধুনিক মেডিকেল সেন্টার। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অত্যাধুনিক উন্নত ও বিশ্বমানের করার লক্ষ্যে কেরাণীগঞ্জে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য দুই হাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে সীমানা নির্ধারণ হয়ে গেছে।
এ বছরের ১১ জানুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সমাবর্তনে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী (১৮ হাজার ২৮৪ জন) অংশগ্রহণ করেন।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদে ৩৬টি বিভাগ ও দুটি ইনস্টিটিউটে ৬৫৭ জন শিক্ষক, প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থী, ৬৬৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে সাতটি শিক্ষাবর্ষে ২১৪ জন শিক্ষার্থী এমফিল ও ৮৭ জন পিএইচডি করছেন।