নিজস্ব প্রতিবেদকঃ- ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে রাজশাহীতে ঝরেপড়া আম করোনাভাইরাসের পরিস্থিতিতে ত্রাণের সাথে বিতরণ করার উদ্যোগে নিয়েছে জেলা প্রশাসন। বাঘা ও চারঘাট উপজেলায় এসব আম প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫০ পয়সায়!
বিষয়টি নিশ্চিত করে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মুহাম্মদ শরীফুল হক বলেন, কৃষক বা চাষিদের আম অবিক্রিত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্রয় করে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে চলমান ত্রাণ হিসেবে দেওয়া হবে। আমরা ইতোমধ্যে আম ক্রয় শুরু করে দিয়েছি। এতে করে চাষিদের কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে যাবে। এর আগে কৃষকদের কাছ থেকে সবজি ক্রয় ত্রাণ তহবিলে দেওয়া হয়েছিল।
গত বুধবার (২০ মে) থেকে রাজশাহীতে গোপালভোগ আমপাড়া শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আবহাওয়া খারাপের কারণে রোদ ঝলমলে দিনের অপেক্ষায় ছিলেন চাষিরা। কিন্তু সে অপেক্ষাই যেন কাল হলো। আম্ফানের মূল ঝাপ্টাটাই গেছে আমের ওপর দিয়ে। এতে অনেক চাষিই এখন নিঃস্ব।
পবা উপজেলার বুধপাড়া এলাকার নাসিম জানান, এবার ১০বিঘা জমিতে আমের বাগান রয়েছে তার। গোপালভোগ, ল্যাংড়া, খিরসাপাতসহ বিভিন্নজাতের আম রয়েছে। এসব গাছে প্রচুর আম ধরেছিল। আর কয়েকদিন পরই আম পাড়া কথা ছিল। কিন্তু গেল ঝড়ে ৮০% আম ঝরে পড়েছে।
আরেক আমচাষি মনির জানান, এবার আমের বাম্পার ফলন হয়েছিল। কিন্তু এক রাতের ঝড়ই আমাদের নিঃস্ব করে দিলো। সরকারের কাছে দাবি, দরিদ্র আমচাষিদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক জানিয়েছেন, ঝড়ে পড়া আম বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দামে কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব আম দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হবে ত্রাণ হিসেবে। এতে পুষ্টির যোগানও হবে তাদের।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামছুল আলম বলেন, ঝড়ে জেলায় কৃষি ফসলের মধ্যে আমেরই বেশি ক্ষতি হয়েছে। পুরো জেলাতে আমের ১২ থেকে ১৫% আম ঝরে পড়েছে। আর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৯৫ থেকে ১০০ কোটি টাকা।
শামছুল হক আরও জানান, এবার রাজশাহীতে ১৭ হাজার ৬৮৬ হেক্টর জমিতে আমের চাষ করা হয়েছে। এর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিকটন। ফলন অনুযায়ী গড়ে ৩৫ টাকা কেজি দরে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ৭৩৫ কোটি টাকা আম বিক্রি করার সম্ভাবনা ছিল। তবে আম্ফানের কারণে তা অর্জিত নাও হতে পারে বলে কৃষি বিভাগের শঙ্কা।
রাজশাহী নগরীতে ১০ থেকে ২০ টাকা কেজিতে ঝড়ে পড়া আম বিক্রি হয়েছে। নগরীর শালবাগান এলাকার ফল ব্যবসায়ী মোশাররফ বলেন, বাঘা ও চারঘাট থেকে ভ্যানে করে আম শহরে নিয়ে আসায় খরচ পড়ে যায় বেশি। এ জন্য নগরীতে আমের দাম বেশি।
বাঘা উপজেলার আড়ানী গোচর গ্রামের আরিফুল ইসলাম বলেন, আমার আমবাগানে প্রতিটি গাছে পরিমাণমতো আম আছে। হঠাৎ ঝড়ে অর্ধেক আম পড়ে গেছে। এই আম বিক্রি করার জায়গা নেই। কেউ কিনতে চাচ্ছে না। ফলে বাড়িতে রাখা হয়েছে।
বাঘা উপজেলার আড়ানী গোচর গ্রামের কড়ালি ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম বলেন, আমরা বরাবর ঝড়ে পড়া আম কিনে ঢাকায় চালান করি। এই আম ৫০ পয়সা কেজি দরে কিনছি।
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, উপজেলায় ৮ হাজার ৩৭০হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। এই ঝড়ে উপজেলায় ২০% ক্ষতি হয়েছে। এ বছর বাগানে আম কম থকায় উৎপাদন ধরা হয়েছে হেক্টর প্রতি ৬ থেকে ৭ মেট্রিক টন। মোট উৎপাদন ধরা হয়েছে ৯৪ হাজার মেট্রিক টন। এরমধ্যে ঝড়ে ক্ষতি হয়েছে ১৮ হাজার মেট্রিক টন।
বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিন রেজা বলেন, এই উপজেলায় খাদ্য শস্যের পাশাপাশি অর্থকরী ফসল হিসেবে আম প্রধান। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উপজেলার আমের সুখ্যাতি সবচেয়ে বেশি। ঝড়ে পড়া আম আমি নিজে চাষিদের কাছে থেকে ৫০ কেজি ওজনের বস্তা ১০০ টাকা (২ টাকা কেজি) দরে ক্রয় করছি।
চারঘাট উপজেলার কালুহাটি গ্রামের আমচাষি বীর বাহাদুর জানান, ঝড়ে আমসহ ভুট্টা ও তিলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। যে আম বিক্রি হতো ৪০ টাকা থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। সেই আম ঝড়ে পড়ায় তা বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫০ পয়সা কেজি দরে। তারপরও আম কেনার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। এমনিতে মহামারি করোনায় আম নিয়ে রয়েছে শঙ্কায়। তার ওপর এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবার জীবনে বয়ে এনেছে কষ্ট। আমবাগানে যেতেই মন ভেঙে পড়ছে। এভাবে কখনও ঝড়ে এমন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি।
চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনজুর রহমান বলেন, “আমের বেশ অনেক ক্ষতি হয়েছে। যা পুষিয়ে ওঠা কঠিন হবে। তবে উপজেলায় গড়ে ১০% আমের ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।”