শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫৫ পূর্বাহ্ন

করোনায় হুমকির মুখে কুমারদের জীবন ব্যবস্থা

বার্তা কক্ষঃ
আজকের তারিখঃ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫৫ পূর্বাহ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ- বিশ্বজুড়ে প্রত্যেকটি দেশের রয়েছে নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতি। এই শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয়েই পরিচিত হয় সেই দেশ বা জাতি। একেকটি শিল্পের বিস্তারের পিছনে রয়েছে একেকটি দেশ বা জাতির অবদান। তেমনই একটি হচ্ছে মৃৎশিল্প।

গ্রাম-বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক -বাহক কুমার শিল্প। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। মৃৎশিল্প শব্দটি ‘মৃৎ’ এবং ‘শিল্প ‘ এ দুই শব্দের মিলিত রূপ। ‘মৃৎ’ শব্দের অর্থ মৃত্তিকা বা মাটি আর ‘শিল্প’ বলতে সুন্দর ও সৃষ্টিশীল বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। এজন্য মাটি দিয়ে তৈরি শিল্পকর্মকে মৃৎশিল্প বলা হয়।আর এই শিল্পের রূপকার হলেন কুমোর বা কুমার শ্রেণির পেশাজীবীরা।রঙের বিন্যাস, কারিগরি দক্ষতা,বাস্তবধর্মী আঙ্গিক,সৌম্য আর সূক্ষ্মতার ব্যঞ্জনায় মৃৎশিল্পীরা যুগ যুগ ধরে সমাদৃত।

কুমাররা মাটি দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করেন।পোড়ামাটির নানাবিধ কাজ,গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি,পুতুল, খেলনা,প্রতিমা, প্রতিকৃতি, শোপিস,হাঁড়ি, কলসি,ঘড়া,ঘাগড়া, সানকি,প্রদীপ,পাঁজাল বা ধুপতি,গ্লাস, বদনা,ঝাঁঝর,চাড়ি,মটকি,পিঠার সাজ,সরা,ঢাকন,বাটি,ফুলের টব,মূর্তিসহ অসংখ্য জিনিস আজও কুমারশালায় তৈরি হয়ে ক্রেতাদের চাহিদা মেটাচ্ছে। এঁটেল মাটি হলো এসব সামগ্রী তৈরির প্রধান উপকরণ। কুমাররা এসব সামগ্রী তৈরি করতে চাকযন্ত্রও ব্যবহার করে থাকেন। কাঁচা মাটি দিয়ে এসব সামগ্রী বানানোর পর পুড়িয়ে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রঙ করে সেগুলো বাজারে বা গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করেন। একসময় কাউকে মাটির তৈরি হাঁড়ি কিংবা গণেশের মূর্তি দিলে বিনিময়ে ঐ পাত্রে বা মূর্তির পেটে যত চাল ধরে ততটাই দেওয়া হতো শিল্পীকে। আজ শিল্পীদের চাল জোটে না, জোটে কিছু নগদ অর্থ। তারপর ও এদেশের কুমাররা ধরে রেখেছেন তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য। বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়া কুমার শিল্প আবার যেন ফিরে আসছে তাঁদের নিখুঁত কাজের মাধ্যমে। কুমারশ্রেণির মানুষেরা যুগ যুগ ধরে এই পেশায় নিযুক্ত। বংশপরম্পরায় তাঁরা এই কাজের সাথে যুক্ত। কুমারদের এই কাজের সাথে তাঁদের স্ত্রী, মেয়েরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কুমারদের জন্য এটাই তাঁদের রোজগারের একমাত্র পথ। এগুলো বিক্রি করেই তাঁদের জীবন চলে।

বৈশাখ মাস যেন তাদের কাছে ‘মলো’ মাস।এমাসে তাদের তৈরি এই মৃৎশিল্পগুলো তৈরির ধুম পড়ে যায়। ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকার সাভার, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কুমারদের মধ্যে তখন এই মাটির তৈরি তৈজসপত্র গুলো বিক্রির যেন একরকম জোয়ার পড়ে যায়। শৌখিন মানুষেরা ঘর সাজাতে ব্যবহার করেন মাটির তৈরি এসব জিনিসপত্র।কুমাররা ও নিজ প্রচেষ্টায় খুব অল্প দামে এই জিনিসগুলো সরবরাহ করে থাকে। তবুও মোটামুটি ভাবে চলে যাচ্ছিল তাঁদের এই জীবন। কিন্তু সম্প্রতি আক্রমণ ঘটল কোভিড-১৯ এর যা করোনা ভাইরাস নামে পরিচিত। এশিয়ার বিভিন্ন অংশ এবং এর বাইরে ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। ভাইরাসটির এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় জনজীবন পড়েছে হুমকির মুখে। সেজন্য সারাদেশকে বর্তমানে লকডাউন করা হয়েছে।এই বৈশ্বিক মহামারীর কারণে সারাবিশ্বে আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড ব্যাহত হয়েছে। এরই সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এই কুমার সম্প্রদায়ের একমাত্র রোজগারের পথ মৃৎশিল্পের। থমকে গেছে কুমারদের জীবনব্যবস্থা।

কুমার সম্প্রদায়ের পরিবারগুলোর সদস্যদের মাঝে চলছে নানা অভাব – অনটন। ফলে তারা চরম হতাশায় দিনাতিপাত করছে। বেকার সময় কাটাতে হচ্ছে তাদের। বন্ধ হয়ে গেছে তাঁদের জীবিকা নির্বাহের পথ। ফলে দারিদ্র্যতার করাল গ্রাসে পতিত হয়েছে তাদের জীবনের চালচিত্র। দিনে আনা দিনে খাওয়া এই মানুষ গুলো বর্তমানে সংকটাপন্ন জীবনব্যবস্থা যাপিত করছে। তাদের এই সংকটকালীন সময়ে পাশে নেই কেউ অথচ তাদের তৈরি এই মৃৎশিল্প গুলোই আমাদের ঐতিহ্যের ধারক। করোনা পরিস্থিতির কারণে এবছরের বৈশাখ মাসটিও তাদের জন্য কোনো আনন্দঘন মুহূর্ত হয়ে উঠতে পারেনি। কুমার পরিবার গুলো আজ অসহায়ের মতো জীবনযাপন করছে। কুমারের হাঁড়িতে আজ চাল নেই, সংসার জীবনে নিভু নিভু করছে প্রদীপ। আমাদের দেশের মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য গড়তে যাদের ভূমিকা প্রধান তাঁরাই আজ নিঃস্ব জীবনযাপন করছে। তাদের উপর নেই কোন সাহায্যের হাত। এই দুঃসময়ে সচ্ছলদের সাহায্যই তাদের এই করুণ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে।তাই সমাজের সচ্ছলরা এই কুমারশ্রেণির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের পাশে অবস্থান করলে একরুণ অবস্থার কিছুটা লাঘব হবে।

বর্তমানে দেশের এই ক্রান্তিকালীন সময়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে কুমার পরিবারগুলো।খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে পরিবারগুলোর মধ্যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর অভাব চরমে উঠেছে ; ত্রাণ ব্যবস্থার অভাবে এই বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি।অর্ধাহারে-অনাহারে,শিশুদের ক্ষুধার আর্তচিৎকারে আকাশ – বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এই কুমার সম্প্রদায়ের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের প্রাচীন এই ঐতিহ্যটি।এটিকে যথাযথ ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব ও আমাদেরই। তাই এই শিল্পের রূপকার তথা কুমারদের এই কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়াতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক- শিক্ষার্থীসহ যুবসমাজের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সাহায্য – সহযোগিতাই পারে তাদের এই সমস্যার নিরসন করতে। তাই কুমার সম্প্রদায়ের এই কষ্টের সময়ে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান,জেলা -উপজেলা পর্যায়, সচ্ছল-দানশীল ব্যক্তিবর্গসহ সকলের এগিয়ে আসা দরকার।


এই বিভাগের আরো খবর........
এক ক্লিকে বিভাগের খবর
error: কপি করার অনুমতি নেই !
error: কপি করার অনুমতি নেই !